মেহেদির রং গাঢ় করার উপায় কি কি? ২০২pexe

মেহেদি বা হেনা আমাদের সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশেষ করে বিয়ে, ঈদ কিংবা অন্যান্য উৎসব উপলক্ষে হাতে-পায়ে মেহেদির নকশা আঁকা আমাদের ঐতিহ্যের একটি সুন্দর প্রকাশ। তবে মেহেদির সৌন্দর্য তখনই পূর্ণতা পায় যখন এর রং গাঢ় ও উজ্জ্বল হয়। অনেকেই মেহেদি লাগানোর পর ফলাফল নিয়ে হতাশ হন, কারণ রং প্রত্যাশিত মতো গাঢ় হয় না।

কিন্তু সঠিক পদ্ধতি ও কিছু কার্যকর উপায় অবলম্বন করলে মেহেদির রং অনেক বেশি সুন্দর এবং গভীর করা সম্ভব। এই রচনায় আমরা আলোচনা করব মেহেদির ভালো রং পাওয়ার বিভিন্ন উপায়, এর পেছনের বিজ্ঞান এবং কিছু ব্যবহারিক পরামর্শ।

মেহেদির রঙ গাড় করার উপায় কি


মেহেদির রং কীভাবে গাঢ় হয়?

মেহেদির রং প্রাকৃতিকভাবে গাঢ় করার জন্য প্রথমে বোঝা দরকার এর রাসায়নিক প্রক্রিয়া। মেহেদি গাছের পাতায় থাকা প্রাকৃতিক রঞ্জক উপাদান ‘লসোন’ (Lawsone) ত্বকের প্রোটিনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে রং ধরায়। এই বিক্রিয়া সম্পূর্ণ হতে সময় লাগে এবং তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও অন্যান্য উপাদান এতে প্রভাব ফেলে। তাই মেহেদির রং গাঢ় করতে হলে লসোনের কার্যকারিতা বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এখন দেখা যাক কীভাবে আমরা এটি করতে পারি।

১. উৎকৃষ্ট মানের মেহেদি নির্বাচন

মেহেদির রং গাঢ় করার প্রথম ধাপ হলো ভালো মানের মেহেদি পাউডার বেছে নেওয়া। বাজারে অনেক সময় নিম্নমানের মেহেদি পাওয়া যায়, যা পুরোনো হয়ে থাকে বা অন্যান্য ফিলারের সঙ্গে মিশ্রিত করা হয়। তাজা মেহেদি পাতা থেকে তৈরি পাউডার সবচেয়ে ভালো ফল দেয়। তাজা মেহেদি সাধারণত গাঢ় সবুজ রঙের হয় এবং এর গন্ধও তীব্র থাকে। প্যাকেটে উৎপাদনের তারিখ দেখে নেওয়া উচিত এবং সম্ভব হলে জৈব (Organic) মেহেদি কেনার চেষ্টা করতে হবে। মেহেদির গুণগত মান যত ভালো হবে, রং তত গাঢ় হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে।


২. সঠিকভাবে মেহেদি মেশানো

মেহেদির পেস্ট তৈরির সময় কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। প্রথমত, মেহেদি মেশানোর জন্য পানির পরিবর্তে লেবুর রস বা চা-পানি ব্যবহার করা যেতে পারে। লেবুর রসে থাকা অ্যাসিড লসোন মুক্ত করতে সাহায্য করে। তবে বেশি লেবুর রস ব্যবহার করলে ত্বক শুকিয়ে যেতে পারে, তাই এটি পরিমিতভাবে মেশাতে হবে। আবার কালো চা বা কফির পানি মেহেদির রং আরও গাঢ় করতে সহায়ক। এছাড়া চিনি যোগ করা যেতে পারে, কারণ চিনি পেস্টকে আঠালো করে এবং ত্বকে ভালোভাবে লেগে থাকতে সাহায্য করে। তবে মনে রাখতে হবে, মিশ্রণটি খুব পাতলা বা খুব ঘন হওয়া উচিত নয়।

৩. মেশানোর পর অপেক্ষা

মেহেদি মেশানোর পর তৎক্ষণাৎ ব্যবহার না করে ৬-৮ ঘণ্টা অপেক্ষা করা উচিত। এই সময়ে লসোন ধীরে ধীরে মুক্ত হয় এবং পেস্টের রং গাঢ় হতে শুরু করে। মিশ্রণটি একটি পাত্রে ঢেকে গরম পরিবেশে রাখলে এই প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। অনেকে রাতে মেহেদি মিশিয়ে সকালে ব্যবহার করেন, যা একটি কার্যকর পদ্ধতি। তবে ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় রাখলে মেহেদির কার্যকারিতা কমে যেতে পারে।

৪. ত্বকের প্রস্তুতি

মেহেদি লাগানোর আগে ত্বক ভালোভাবে পরিষ্কার করা জরুরি। ত্বকে তেল, ক্রিম বা ময়লা থাকলে মেহেদি ঠিকমতো লাগবে না। সাবান দিয়ে হাত-পা ধুয়ে শুকিয়ে নিতে হবে। এছাড়া মেহেদি লাগানোর আগে ত্বকে হালকা ইউক্যালিপটাস তেল (Eucalyptus Oil) মাখলে রং গাঢ় হয়। এই তেল ত্বকের ছিদ্র খুলে দেয় এবং মেহেদির রঞ্জক ভালোভাবে প্রবেশ করতে সাহায্য করে। তবে অতিরিক্ত তেল ব্যবহার করা যাবে না, কারণ তেল মেহেদির শোষণে বাধা দিতে পারে।

৫. মেহেদি লাগানোর কৌশল

মেহেদি লাগানোর সময় পেস্টটি ত্বকে মোটা করে লাগাতে হবে। পাতলা স্তরে লাগালে রং হালকা হয়ে যেতে পারে। নকশা আঁকার পর তাড়াহুড়ো করে মেহেদি তুলে ফেলা যাবে না। কমপক্ষে ৬-৮ ঘণ্টা ত্বকে রাখতে হবে। অনেকে রাতে মেহেদি লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন, যাতে এটি শুকিয়ে যাওয়ার পর্যাপ্ত সময় পায়। মেহেদি শুকিয়ে গেলে হাত-পা গরম রাখার জন্য মোজা বা গ্লাভস পরা যেতে পারে। তাপ মেহেদির রং গাঢ় করতে সহায়তা করে।

৬. মেহেদি শুকানোর পর যত্ন

মেহেদি শুকিয়ে গেলে এটি ঘষে তুলে ফেলতে হবে, ধোয়া যাবে না। পানি দিয়ে ধুলে রং হালকা হয়ে যেতে পারে। এরপর লবঙ্গের ধোঁয়া বা তাপ নেওয়া যেতে পারে। একটি প্যানে লবঙ্গ গরম করে তার ধোঁয়ার ওপর হাত-পা ধরলে মেহেদির রং আরও গাঢ় হয়। এছাড়া সরিষার তেল বা ভিক্স মাখলে রং উজ্জ্বল হয়। তবে তেল বেশি ব্যবহার করলে ত্বক চিটচিটে হয়ে যেতে পারে, তাই পরিমিতি বজায় রাখতে হবে।

৭. পরবর্তী যত্ন

মেহেদি লাগানোর পর কমপক্ষে ২৪-৪৮ ঘণ্টা পানি থেকে দূরে রাখতে হবে। এই সময়ে রং পুরোপুরি ত্বকে বসে যায়। সাবান, ডিটারজেন্ট বা অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে। ত্বক শুকিয়ে গেলে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে তৈলাক্ত ক্রিম এড়িয়ে চলাই ভালো।
নখের মেহেদী কালো করার উপায়

কিছু সাধারণ ভুল এড়ানো

মেহেদির রং গাঢ় করতে গিয়ে অনেকে কিছু ভুল করে ফেলেন। যেমন,Hosঅনেকে কৃত্রিম রং মিশ্রিত মেহেদি ব্যবহার করেন, যা ত্বকের জন্য ক্ষতিকর। আবার কেউ কেউ মনে করেন বেশি সময় মেহেদি রাখলেই রং গাঢ় হবে, কিন্তু ১২ ঘণ্টার বেশি রাখলে উল্টো ফল হতে পারে। তাই প্রাকৃতিক উপায়ে এবং সঠিক সময় মেনে চলা জরুরি।

গাছের মেহেদির রং গাঢ় করার উপায়

১. তাজা মেহেদি পাতা ব্যবহার
গাছ থেকে সদ্য তোলা তাজা মেহেদি পাতা সবচেয়ে ভালো রং দেয়। পাতা যত তাজা হবে, তাতে লসোন (Lawsone) নামক প্রাকৃতিক রঞ্জকের পরিমাণ তত বেশি থাকবে। তাই সম্ভব হলে গাছ থেকে পাতা তুলে তা বেটে বা গুঁড়ো করে তৎক্ষণাৎ ব্যবহার করুন। পুরোনো বা শুকনো পাতার তুলনায় তাজা পাতার রং অনেক গাঢ় হয়।
২. সঠিক মিশ্রণ তৈরি
  • লেবুর রস: মেহেদি পাতা বাটার সময় সামান্য লেবুর রস মেশান। এটি লসোন মুক্ত করতে সাহায্য করে, যা রং গাঢ় করে। তবে বেশি লেবু ব্যবহার করবেন না, কারণ এতে ত্বক শুকিয়ে যেতে পারে।
  • চিনি: পেস্টে এক চিমটি চিনি মেশালে এটি আঠালো হয় এবং ত্বকে ভালোভাবে লেগে থাকে, ফলে রং গভীর হয়।
  • চা-পানি বা কফি: পানির পরিবর্তে গাঢ় চা বা কফির পানি ব্যবহার করলে মেহেদির রং আরও উজ্জ্বল ও গাঢ় হয়।
৩. পেস্ট রেখে দিন
মেহেদি পাতা বেটে পেস্ট তৈরি করার পর তা ৬-৮ ঘণ্টা ঢেকে গরম জায়গায় রেখে দিন। এই সময়ে লসোন ধীরে ধীরে মুক্ত হয়, যা রং গাঢ় করতে সাহায্য করে। তবে ২৪ ঘণ্টার বেশি রাখবেন না, কারণ তাতে কার্যকারিতা কমে যেতে পারে।
৪. ত্বক প্রস্তুত করুন
মেহেদি লাগানোর আগে হাত-পা ভালোভাবে ধুয়ে শুকিয়ে নিন। ত্বকে তেল বা ক্রিম থাকলে মেহেদি ঠিকমতো লাগবে না। হালকা ইউক্যালিপটাস তেল মাখতে পারেন, এটি ত্বকের ছিদ্র খুলে রং গাঢ় করতে সহায়ক।
৫. মেহেদি লাগানোর পদ্ধতি
  • পেস্টটি ত্বকে মোটা স্তরে লাগান। পাতলা করে লাগালে রং হালকা হতে পারে।
  • লাগানোর পর ৬-৮ ঘণ্টা রাখুন। রাতে লাগিয়ে ঘুমানো সবচেয়ে ভালো। শুকানোর সময় হাত-পা গরম রাখতে মোজা বা গ্লাভস পরতে পারেন।
৬. শুকানোর পর যত্ন
  • মেহেদি শুকিয়ে গেলে ঘষে তুলুন, পানি দিয়ে ধোবেন না।
  • লবঙ্গের ধোঁয়া নিন: একটি প্যানে লবঙ্গ গরম করে তার ধোঁয়ার ওপর হাত-পা ধরলে রং গাঢ় হয়।
  • সামান্য সরিষার তেল বা ভিক্স মাখতে পারেন, তবে বেশি তেল এড়িয়ে চলুন।
৭. পরবর্তী ২৪-৪৮ ঘণ্টা
মেহেদি লাগানোর পর ২৪-৪৮ ঘণ্টা পানি, সাবান বা রাসায়নিক থেকে দূরে রাখুন। এই সময়ে রং ত্বকে পুরোপুরি বসে যায়।
অতিরিক্ত টিপস
  • গাছের মেহেদি হালকা হলে পাতা সংগ্রহের সময় দেখুন। গ্রীষ্মকালে মেহেদি পাতায় লসোন বেশি থাকে।
  • কৃত্রিম রং বা কেমিক্যাল মেশাবেন না, এতে ত্বকের ক্ষতি হতে পারে.
কোন মেহেদি বেশি ভাল?
২. জামুনি মেহেদি (Jamuni Henna)
  • উৎপত্তি: ভারত ও পাকিস্তানের কিছু অঞ্চল।
  • বৈশিষ্ট্য: এটি গাঢ় বাদামী থেকে গভীর মেরুন রং দেয়, যা অনেকের পছন্দ।
  • কেন ভালো: প্রাকৃতিকভাবে উচ্চমানের এবং ত্বকের সঙ্গে ভালো বিক্রিয়া করে।
৩. ইয়েমেনি মেহেদি (Yemeni Henna)
  • উৎপত্তি: ইয়েমেন।
  • বৈশিষ্ট্য: এটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম গুঁড়ো এবং গাঢ় লালচে রং দেয়। অনেকে এটিকে সবচেয়ে প্রিমিয়াম মেহেদি মনে করেন।
  • কেন ভালো: উৎপাদন প্রক্রিয়া খুব যত্নসহকারে করা হয়, ফলে রং দীর্ঘস্থায়ী হয়।
৪. মরক্কান মেহেদি (Moroccan Henna)
  • উৎপত্তি: মরক্কো।
  • বৈশিষ্ট্য: এটি গাঢ় কমলা থেকে লালচে রং দেয় এবং নকশার জন্য উপযুক্ত।
  • কেন ভালো: ত্বকের সঙ্গে দ্রুত মিশে যায় এবং প্রাকৃতিক গন্ধ থাকে।

মেহেদির ভালো রং পাওয়া কোনো জাদু নয়, বরং এটি সঠিক উপায় ও যত্নের সমন্বয়। ভালো মানের মেহেদি, সঠিক মিশ্রণ, ত্বকের প্রস্তুতি এবং পরবর্তী যত্ন – এই সবকিছু মিলিয়ে আপনি পেতে পারেন গাঢ় ও সুন্দর রং। এই প্রক্রিয়া শুধু আপনার হাতের সৌন্দর্যই বাড়ায় না, বরং আমাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে গভীর সংযোগ তৈরি করে। তাই পরবর্তীবার মেহেদি লাগানোর সময় এই উপায়গুলো মেনে চলুন, আর উপভোগ করুন প্রকৃতির এই অপরূপ উপহার।
Previous Post